বৃদ্ধা ফিরোজা বেগমের জীবন যেন এক কষ্টের সুতােয় গাথা
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
৩০ বছরের পুরোনো ১৬ হাত মাটির ঘরে বসবাস ৭৩ বছর বয়সী বৃদ্ধা ফিরোজা বেগমের।সেই পুরোনো মাটির ঘর ভেঙ্গে গেছে।ভাঙাচোরা মাটির ঘরে পুরোনো টিনের ছিদ্র দিয়ে ঘরিয়ে পরে পানি।চার বছর আগে মাটির ঘরের এক পাশের দেয়ালও গেছে ধসে।
সেই ভাঙাচোরা মাটির ঘরে আশ্রয় নিয়ে কাটছে তার মানবেতর জীবন-যাপন।ফিরোজা বেগমের জীবন যেন এক কষ্টের সুতােয় গাথা।সেই ভাঙা মাটির ঘরেই কুরআন তেলাওয়াত আর নামাজ পড়েন।রাতে জায়নামাজের ওপর বসানো একটি পুরোনো চৌকিতেই ঘুমাতে হয় তাঁকে।
ঝড়-বৃষ্টি একসাথে হলে ওই ঘরেই থাকেন তিনি।ভাঙ্গা মাটির ঘর চারিদিকে হেলে পড়েছে।যে কোন মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে। ২০ বছর আগে স্বামীর মৃত্যুর পর নতুন ঘর তৈরি করতে পারেননি টাকার অভাবে।তিন ছেলের আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়।ছেলেরাও দিন আনে দিন খাই।বসতবিটা ছাড়া নেই জমিজমা।
ফিরোজা বেগম টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার কালিয়া ইউনিয়নের কচুয়া পূর্বপাড়া এলাকার মৃত আবু তালেব মিয়ার স্ত্রী।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়,১৬ হাত ভাঙ্গাচোরা মাটির ঘরের এক কোণে চৌকিতেই নামাজ পড়েন।সেখানেই রাত হলে শুয়ে থাকেন।মাটির ঘরে একপাশের দেয়াল ভেঙে গেছে। সেই ভেঙে যাওয়া দেয়ালে বেড়া দিয়েছেন বস্তা দিয়ে। মরিচাধরা পুরোনো টিন, টিনে অসংখ্য ছিদ্র।নেই বিদ্যুতের লাইন।মাটির দেয়ালে রয়েছে অসংখ্য ফাটল। নেই কোন শুয়ার খাট,টিউবওয়েল, টয়লেট।ফিরোজা বেগমের তিন ছেলে শহীদ ভ্যানচালক, বুলবুল চা বিক্রেতা, জব্বার প্রবাসী হলেও কোনো মতে চলছে তাদের সংসার।
বৃদ্ধা ফিরোজা বেগম বলেন,আমার স্বামী ২০ বছর আগে মারা গেছে।আমার স্বামী ৩০ বছর আগে মাটির ঘর দিয়েছিল।আমি সেই মাটির ঘরেই থাকি।এই মাটির ঘরে থেকেই আমার স্বামী মারা গেছে।ইচ্ছে করছিলাম এই ঘরে থেকেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করব।এখন তা হলো না।আমার মাটির ঘর ভেঙ্গে গেছে।চার বছর ধরে আমার ঘর ভেঙ্গে গেছে।এই ভাঙ্গা ঘরেই নামাজ ও কুরআন পড়ি।
তিনি বলেন,আমি অসহায় মানুষ।আমার ছেলেদের জমি নাই।তাদেরও চলতে কষ্ট হয়।কাজ করলে তাদের সংসার চলে। কাজ না করলে তাদের সংসার চলে না।আমার যখন যা মিলে তখন তাদের সাথে খাই।
ছেলেদের বলতে পারি না,আমাকে ঘর দিয়ে দাও।আমার ছেলেদের দেখলেই মন ভরে ওঠে।অন্য মানুষের বাড়িতে গোসল করতে যাই।মানুষ কত কথা বলে।আমার নাই টিউবওয়েল, টয়লেট। পৃথিবীর বুকে বেঁচে আছি কত কষ্ট।স্বামী ছাড়া কত কষ্টে আমার জীবন যাচ্ছে চলে।আমি কারও কাছে বলতে পারি না।যখন বৃষ্টি হয় তখন এই ঘরে থাকতে পারি না।তখন ছেলে ও ছেলের বউরা ঘরে ডেকে নিয়ে যায়।
ফিরোজা বেগমের বড় ছেলের বউ নার্গিস আক্তার বলেন,আমার শাশুড়ীর ঘর নাই।খুবই কষ্ট করে।আমরাও তো ঘর দিয়ে দিতে পারি না।আমাদের অবস্থাও খুব খারাপ।শাশুড়ির তিন ছেলেদের অবস্থায় খারাপ।আমার স্বামী ও দুই দেবর আছে তারাও ঘর করে দিতে পারে না।
যে ঘর আছে সেই ঘরে থাকতে পারে না।ঘর দিয়ে পানি পড়ে।এই ঘরেই নামাজ পড়ে ও থাকে।ঝড়-বৃষ্টি হলে আমরা ডেকে নেয়।এভাবেই আমরা শাশুড়িকে রাখি। কি করব?আমরা তো ঘর করে দিতে পারি না।
স্থানীয় বাসিন্দা হারুন মিয়া বলেন,আমি জন্মের পর থেকেই দেখছি, তিনি এই মাটির ঘরে থাকেন।এই ঘরের বয়স ৩০ বছর হয়েছে।চার বছর আগে এই ঘরের দেয়াল ভেঙ্গে গেছে।যখন বৃষ্টি হয় তখন ঘরের মধ্যে পানি পড়ে। বৃদ্ধার খাওয়ার কষ্ট হয়।বৃদ্ধার তিন ছেলে আছে তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো না।তারাও আর্থিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। তারাও ঘর করে দিতে পারছে না।
স্থানীয় ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলাম বলেন,ফিরোজা বেগম অত্যন্ত অসহায় একজন মানুষ।বৃদ্ধার স্বামীর রেখে যাওয়া মাটির ঘর দিয়ে গেছেন।সেই মাটির ঘর একেবারে ভেঙ্গে গেছে।এই ঘরে থাকাটা ঝুঁকিপূর্ণ।থাকার মতো পরিবেশ এই ঘরে নেয়।তিনি অসহায় মানুষ।তার ছেলেরা চা বিক্রি করে খাই।তার ছেলেরা তাকে ঘর করে দিতে পারছে না।আমি এলাকার বিত্তবান লোকদের বলব ওনার জন্য এগিয়ে আসার এবং বিনয়ের সাথে অনুরোধ করছি।
তিনি বলেন,তিনি ৭০ বছরের বৃদ্ধা মহিলা।তিনি এই ঘরে কুরআন তেলাওয়াত করেন।ওনার ইচ্ছা সুন্দর ভাবে কুরআন তেলাওয়াত করে বাকি জীবনটা শেষ করতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, ১২ হাত ঘর,টয়লেট, মটার করে দিতে হলে এক লাখ টাকার মতো খরচ হবে।ইউএনও স্যার টিন,খাদ্য সামগ্রী, নগদ অর্থ দিয়েছেন।এছাড়াও আমরাও নগদ অর্থ দিয়েছে।তা দিয়ে ঘর করা সম্ভব না।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মনসুর আহমেদ বলেন,বৃদ্ধাকে বয়স্ক ভাতা করে দেয়া হয়েছে।এছাড়াও ইউএনও স্যার টিন, শুকনো খাবার ও আর্থিক সহযোগিতা করছেন।
তিনি বলেন,সমাজের গন্যমান্য ও বিত্তবান ব্যক্তিরা যদি না এগিয়ে আসে সরকারি সহায়তা দিয়ে স্বাবলম্বী করা সম্ভব না।যতটুকু করার সমর্থ ছিল ইউএনও স্যার করেছে।আমাদের ভাতা তো সে পাই।
উল্লেখ্য, বিভিন্ন গন্যমাধ্যমে ফিরোজা বেগমকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হলে গত সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) বিকেলে বৃদ্ধা ফিরোজা বেগমের বাড়িতে উপজেলার কচুয়া গ্রামের পূর্বপাড়া এলাকায় ঘর তৈরির টিন, বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রী, নগদ অর্থ নিয়ে হাজির হন (ইউএনও) মো. আবদুল্লাহ আল রনী।
